বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, ত্রিপুরার এক রাজনীতিবিদ ‘বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার’ আহ্বান জানিয়েছেন। এই বিতর্কিত মন্তব্যটি করেছেন ত্রিপুরার দ্বিতীয় বৃহত্তম দল টিপরা মোথার প্রতিষ্ঠাতা প্রদ্যোৎ মাণিক্য।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মাণিক্য পরামর্শ দিয়েছেন যে, দিল্লি যেন ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মূল ভূখণ্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘শত শত কোটি টাকা খরচ’ না করে বরং বাংলাদেশের এমন অংশগুলো দখল করে নেয়, যা ‘সবসময়ই ভারতের অংশ হতে চেয়েছে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং তাদের মঙ্গলের জন্য এটি ব্যবহার করা উচিত।’ মাণিক্য আরও বলেন, ‘যদি আমরা বাংলাদেশকে ভেঙে নিজেদের জন্য সমুদ্রপথ তৈরি করি, তবে এটি হয়তো আরও সুবিধাজনক হবে, কারণ এই ধরনের চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল পরিকল্পনায় বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচের প্রয়োজন পড়বে না।’
ত্রিপুরার এই নেতা দাবি করেন, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল এবং ১৯৪৭ সাল থেকেই তারা ভারতের অংশ হতে চেয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে লাখ লাখ ত্রিপুরি, গারো, খাসি ও চাকমা জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিতে অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছে। তাদের স্বার্থ রক্ষা করেই ভারতের জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা উচিত।
প্রদ্যোৎ মাণিক্যের মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিলেও তিনি নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশ কখনোই আমাদের বন্ধু ছিল না… তাই আসুন আমরা বোকা না হই।’ তার মতে, ভারতে বাংলাদেশের একমাত্র ‘বন্ধু’ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাস করি এবং প্রতিদিন স্পষ্ট বিপদ দেখতে পাই। আমি বুঝতে পারছি, আপনার বামপন্থী মনোভাব এটিকে কঠিন করে তোলে… তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করুন।’
প্রদ্যোৎ মাণিক্যের এই মন্তব্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বক্তব্যের সম্প্রসারণ বলে মনে হচ্ছে। বিশ্বশর্মা ড. ইউনূসের মন্তব্যকে ‘আপত্তিজনক’ ও ‘তীব্র নিন্দনীয়’ বলে অভিহিত করেছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রেল ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর আগে, ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য সম্পূর্ণরূপে স্থলবেষ্টিত। তাদের সমুদ্রের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। আমরা এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রপথের একমাত্র অভিভাবক।’
এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেন, ‘এই মন্তব্যটি ভারতের কৌশলগত চিকেনস নেক করিডরের দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা তুলে ধরে।’ তিনি বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ স্থাপনে বিকল্প সড়ক ও রেলপথ তৈরির কাজ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
বিশ্বশর্মা আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর নয়, বরং দিল্লি এটিকে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় পণ্য পরিবহনের জন্য একটি ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ব্যবহার করছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলকাতা বন্দর থেকে আগরতলায় পণ্য পরিবহন খরচ প্রতি টনে ৬,৩০০ থেকে ৭,০০০ টাকা হলেও, চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরায় পরিবহন খরচ অনেক কম।
এই বিতর্কিত মন্তব্যের পর, ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।