২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী দ্রুত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। দীর্ঘদিন দমন-পীড়নের শিকার হওয়া দলটি এখন আবারও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান তৈরি করছে।
স্থানীয় সূত্রে ও দ্য ডিপ্লোম্যাট জানিয়েছে, জামায়াত বর্তমানে দেশের প্রধান প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত। দলের সদস্যরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের ভূমিকা দখল করছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে জামায়াত নতুনভাবে গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)-র সঙ্গে জোট বেঁধেছে। এনসিপি, যা প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডাকে নিজের প্রভাবের মধ্যে আনতে চাইছে।
মে মাসে জামায়াত ও এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা সরকারের সময় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন; এর মধ্যে গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, দেলওয়ার হোসেইন সাঈদী ও কামারুজ্জামান উল্লেখযোগ্য।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করেছিল। ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয় এবং ২০২৫ সালের ১ আগস্ট দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। নিষেধাজ্ঞার পর অনেক নেতা পরিচয় গোপন করে সরকারি চাকরি বা ছাত্রসংগঠনে প্রবেশ করেছিলেন।
বর্তমানে জামায়াত ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবামূলক কার্যক্রমের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তবে সমালোচকদের মতে, নারীদের ও সংখ্যালঘুদের সমঅধিকারে দলের অবস্থান এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু নারী-বান্ধব ও সংখ্যালঘুবান্ধব বক্তব্য দিলেও এটি কৌশলগত পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে, মৌলিক আদর্শগত নয়।
জামায়াতের বক্তব্য অনুযায়ী, নীতি প্রণয়ন হবে আল্লাহ ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নির্দেশনার ভিত্তিতে। দলের ওয়েবসাইট ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ’লা মওদুদীর বই গুরুত্বসহকারে রাখা হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন, মওদুদীর চিন্তাভাবনা বোঝার জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দমননীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা প্রয়োজন।
দলটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও প্রভাব বিস্তার করছে এবং বিএনপিবিরোধী বক্তব্য মূলধারায় আনতে সক্ষম হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় গোপন করে কার্যক্রম চালানো ছাড়াও, জুলাই আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে জামায়াত-সম্পৃক্ত সংগঠনগুলো, যেখানে সাবেক মার্কিন কূটনীতিকও উপস্থিত ছিলেন।
জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের এনসিপির সঙ্গে সংযুক্তির ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার দায়ে জামায়াত কলঙ্কিত ছিল, বর্তমান প্রজন্মের ভোটারদের কাছে এ বিষয়টি আগের মতো প্রভাব ফেলছে না। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “৭১-এর পক্ষে কে আর বিপক্ষে কে— এই রাজনীতি দেশের জন্য পুরনো কাঠামো।”
জামায়াত শুধু এনসিপি নয়, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে বৃহত্তর জোট গড়ার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের জোট বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিকে ক্রমশ ডানপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলস্বরূপ, ঐতিহ্যগত মধ্য-ডানপন্থি বিএনপি তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থার দিকে সরে আসছে।
ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত এখনও এককভাবে বড় শক্তি নয়। তাই তারা এনসিপির সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে। একইসঙ্গে দলটি নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিও তুলেছে, যেখানে বর্তমান ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতি বাতিল করে অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) চালুর প্রস্তাব করছে।
জামায়াতের পুনরুত্থান শুধু দেশের রাজনীতির জন্য নয়, আন্তর্জাতিক ইসলামি রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। তুরস্ক বর্তমানে জামায়াতসহ রক্ষণশীল ইসলামি শক্তিগুলোর ওপর আর্থিক ও কৌশলগত প্রভাব বাড়াচ্ছে, যার ফলে ভারতের প্রভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও কমে যেতে পারে।

